IQNA

বাংলা উচ্চারণে কোরআন পড়া যাবে?

5:32 - April 14, 2022
সংবাদ: 3471703
তেহরান (ইকনা): অনেককে দেখা যায়, তারা বাংলা উচ্চারণ দেখে এর অনুরূপ কোরআন পাঠ করে থাকেন। অথচ আরবি ছাড়া অন্য ভাষায় কোরআনের সঠিক উচ্চারণ অসম্ভব। তাই কোরআন শরিফকে অন্য ভাষায় লেখা বা পড়া উলামায়ে কেরামের ঐকমত্যে নাজায়েজ। এতে কোরআনের শব্দ ও অর্থ বিকৃত হয়ে যায়, যা সম্পূর্ণ হারাম।

তাই কোনো আলেমের তত্ত্বাবধানে কোরআন শিখে নিতে হবে। (আল ইতক্বান : ৮৩০-৮৩১, ইমদাদুল আহকাম : ১/২৪০, ফাতাওয়ায়ে মাহমুদিয়া : ১/৪৩)

শুধু তা-ই নয়, এমনকি আরবি ভাষা ঠিক রেখেও কোরআন শরিফের বিশেষ রসমূল খত তথা লেখারীতির বিপরীত লেখাও ইমামদের ভাষ্যমতে নিষিদ্ধ। (ফাজায়েলুল কোরআন, ইবনে কাসির : ৫০, আল ইতকান : ৮৩০-৮৩১, আননুসুসুল জালিয়্যাহ : ২৫)

 

বাংলা বা যেকোনো অনারবি ভাষায় কোরআনের উচ্চারণ লেখার আরেকটি ক্ষতিকর দিক হলো, এর দ্বারা মানুষ সঠিকভাবে কোরআন না শিখে শুধু উচ্চারণনির্ভর ভুল কোরআন পাঠে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে। অথচ প্রত্যেক নর-নারীর ওপর কোরআন এতটুকু সহিহ-শুদ্ধ করে পড়া ফরজে আইন, যার দ্বারা অর্থ পরিবর্তন হয় না। অর্থ পরিবর্তন হয়—এমন ভুল পড়ার দ্বারা নামাজ নষ্ট হয়ে যায়। অতএব, কমপক্ষে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য যে সুরাগুলো প্রয়োজন, সেগুলো শুদ্ধ করে নেওয়া আবশ্যক, অন্যথায় সে গুনাহগার হবে। আর পূর্ণ কোরআন শুদ্ধভাবে শেখা সবার ওপর সুন্নতে মুয়াক্কাদা ও ফরজে কেফায়া। অর্থাৎ প্রত্যেক এলাকায় পূর্ণ কোরআন শুদ্ধভাবে পাঠকারী একটি দল থাকা আবশ্যক। (মুকাদ্দামায়ে জাজারিয়া : ১১, মাআরেফুল কোরআন : ৪/৪৮৯)

 

আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যারা সহিহ-শুদ্ধভাবে কোরআন তিলাওয়াত করে, তারা নেককার সম্মানিত ফেরেশতাদের সমতুল্য মর্যাদা পাবে এবং যারা কষ্ট সত্ত্বেও কোরআন সহিহ-শুদ্ধভাবে পড়ার চেষ্টা ও মেহনত চালিয়ে যায়, তাদের জন্য রয়েছে দ্বিগুণ সওয়াব। ’ (আবু দাউদ, হাদিস : ১৪৫৪)

 

সাধারণ মানুষের কোরআন শেখার এই ধরনের পদ্ধতিকে কেন হারাম ঘোষণা করা হয়েছে? এর কারণ হলো,

 

আসলে এক ভাষার মাধ্যমে অন্য ভাষার অনুবাদ হয় না। ভাবের অনুবাদ হয়। এক ভাষার বর্ণমালার উচ্চারণ আরেক ভাষার বর্ণমালায় সম্ভব নয়। কেননা প্রতিটি ভাষার স্বতন্ত্র বর্ণমালা আছে, যেগুলো সংখ্যা ও বৈশিষ্ট্যে অন্য ভাষার চেয়ে আলাদা। ইংরেজি (ঠ) ভির উচ্চারণ আরবিতে ও বাংলায় সম্ভব? কস্মিনকালেও সম্ভবপর না। আরবি দ্বাদ-এর উচ্চারণ পৃথিবীর কোনো ভাষায় সম্ভব নয়। আরবি ‘কাফ’ হরফের উচ্চারণ দুই জায়গা থেকে হয়। ‘হা’ উচ্চারণও দুভাবে হয়। আরবি প্রতিটি হরফের জন্যই আলাদা মাখরাজ বা উচ্চারণের বিশেষ স্থান আছে। এর সামান্য বেশকম হলে কোরআনের শব্দের অর্থের বিরাট ব্যবধান হয়ে যাবে। তখন সওয়াবের পরিবর্তে গুনাহও হয়ে যেতে পারে। যেমন—‘আউজু’। এখানে ‘আলিফ’, ‘আইন’, ‘ওয়াও’ ও ‘জাল’—এই চারটি অক্ষর আছে। এখানে আইন অক্ষরটি সঠিক স্থান থেকে উচ্চারিত না হলে তা হবে হামজার উচ্চারণে। ফলে হামজা অক্ষর দিয়ে উচ্চারিত হয়ে যে ‘আউজু’ শব্দ গঠিত হবে তার অর্থ হবে, আমি কষ্ট চাই। অথচ ‘আউজু বিল্লাহি’...এর সঠিক উচ্চারিত শব্দটির অর্থ হলো, আমি আশ্রয় চাই আল্লাহর কাছে।

 

কোরআনের সূচনা হয়েছে ‘আল-হামদু’ শব্দের মাধ্যমে। এখানে যে ‘হা’ আছে, সেটি ‘জিম’ হরফের পরের ‘হা’ হরফ। এর অর্থ হবে ‘সব প্রশংসা’। কিন্তু আরবিতে আরো একটি ‘হা’ হরফ আছে, সেটি হামজার পরের ‘হা’। এখন এ ‘হা’ হরফ দিয়ে যদি ‘হামদু’ শব্দ উচ্চারণ করা হয়, তাহলে তার অর্থ হবে মৃত্যু ও আগুনের তাপ। তাই এ ‘হা’ হরফ দিয়ে যদি কেউ ‘আলহামদু’ পড়ে, তাহলে বিকৃত অর্থ হয়ে যাবে।

 

কোরআনের একটি শব্দ ‘আলিম’। যার শুরুতে রয়েছে ‘আইন’ হরফ, যা ‘গাইন’ হরফের আগের হরফ। এর অর্থ হলো অতিশয় জ্ঞানী। তাই ‘আল্লাহু আলীমুন’-এর অর্থ হবে আল্লাহ অতিশয় জ্ঞানী। কিন্তু একই উচ্চারণে ‘আলিম’রূপে পৃথক একটি শব্দ আছে, যার শুরুতে হামজা হরফ রয়েছে। এর অর্থ হলো কঠিন পীড়াদায়ক। যেমন—‘আজাবুন আলিম’ অর্থ কঠিন পীড়াদায়ক শাস্তি।

 

কোরআনে ব্যবহৃত একটি শব্দ হলো ‘কলম’। এর অর্থ কলম বা লেখার উপকরণ। কিন্তু এ শব্দে যদি হরকত (যবর-যের-পেশ) দেওয়া হয়, তাহলে তা হবে ‘কালাম’। অথচ আরবিতে ‘কালাম’ পৃথক একটি শব্দ। এর অর্থ কথা।

 

যাঁরা বাংলা উচ্চারণে কোরআনের হরফ লিখেছেন, তাঁদের লেখায় দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁরা শব্দের শেষে থাকা আরবি ‘গোল তা’-কে ফেলে দিয়েছেন। যেমন—‘তাওবাহ’ থেকে ‘তাওবা’, ‘রাহিনাহ’ থেকে ‘রাহিনা’। এটাও এক ধরনের শব্দের বিকৃতি।

 

‘কলেমাতুন’ শব্দটি কোরআনে অনেক জায়গায় এসেছে। কিন্তু বাংলা উচ্চারণে এ শব্দকে লেখা হয় ‘কলেমা’। আরবিতে শব্দটির অর্থ হলো কথা, বাণী ও তাওহিদের কলেমা। কিন্তু বাংলা ভাষায় ‘কলেমা’ অর্থ মলিনতা, কালির দাগ ও কলঙ্ক।

 

বাংলা উচ্চারণে এ ধরনের জটিলতা থাকায় বিজ্ঞ আলেমরা বাংলা উচ্চারণসমৃদ্ধ কোরআন পাঠ করতে নিষেধ করেছেন। কেননা আরবি ভাষার সঠিক উচ্চারণেই কোরআন পড়া জরুরি। এর ব্যতিক্রম করা যাবে না।

 

এ ব্যাপারে বিশ্বের বড় বড় আলেমও তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন : ইবনে ফারিস, কাজি আইয়াজ, ইবনে আরবি, শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া, রশিদ রেজা, আশরাফ আলী থানভি (রহ.), শেখ মোহাম্মদ আবদুল আজিম আল জুরকানি (আল-আজহার, মিসর), শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ দরাজ (মিসর), শেখ তাহের আহমদ জাভি (লিবিয়া), শেখ আবদুল্লাহ বিন ইবরাহিম আল আনসারী (দোহা, কাতার), মুফতি মাহমুদ হাসান গংগুহি (ভারত), শেখ আবদুল হামিদ তাহমাজ (রিয়াদ) ও ফকিহুল মিল্লাত মুফতি আবদুর রহমান (রহ.) (বাংলাদেশ) প্রমুখ আলেম বলেছেন, আরবি ছাড়া অন্য ভাষায় আরবি হরফের সঠিক উচ্চারণ হয় না। তাই অন্য কোনো ভাষায় উচ্চারণ করে কোরআন পড়লে তা হবে ভুল। (ড. হাফেজ এ বি এম হিজবুল্লাহ, উজুবু কিতাবুল মাসহাফুস-শারিফ বিল-হরুফুল আরাবিয়া মায়াল ইলতিজামি বিররুসমিল উসমানি, প্রথম সংস্করণ, অক্টোবর, ২০১৩)

 

 

captcha