বার্তা সংস্থা ইকনা: পরিস্তিতিকে ব্যাখ্যা করার জন্য আমি তিনটি এলোমেলো ও সম্পর্কহীন উদাহরণ দেব।
২০ বছর বয়সী পাকিস্তানি-আমেরিকান রাহিল সিদ্দিকী মিশিগানের টেলারের ‘ট্রুম্যান হাই স্কুল’ এর শীর্ষস্থানীয় একজন ছাত্র ছিলেন। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে তিনি তার জাতিকে সেবা করার স্বপ্ন নিয়ে মার্কিন নৌ-বাহিনীতে যোগদান করেন।
এর কয়েক মাস পর সাউথ ক্যারোলিনার ‘পারিস আইল্যান্ড’ মার্কিন মেরিন বুট ক্যাম্পে তিনি তার শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেন। গলায় আঘাত নিয়ে অভিযোগ করার অপরাধে ‘ড্রিল সার্জেন্ট’ জোসেফ ফেলিক্স তাকে অপমান করার পাশাপাশি তার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দেন। এই অপমান সহ্য করতে না পেরে সিদ্দিকী ব্যারাকের তৃতীয় তলা লাফ দেন এবং কংক্রিটের সিঁড়ির ওপর পড়ে যান এবং দুঃখজনকভাবে তার মৃত্যু ঘটে। পরে তার মৃত্যুকে নিছকই আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া হয়।
ছেলের মৃত্যুতে অত্যন্ত শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সিদ্দিকীর পরিবার। একাধিক মিডিয়া সাক্ষাত্কারে পরিবারের সদস্যরা তার আত্মহত্যার বর্ণনাকে চ্যালেঞ্জ করেন।
‘কমান্ডের বহুবিধ স্তর’ অবহেলার জন্য পরিবারটি মেরিন কর্পসের বিরুদ্ধে ১০০ মিলিয়ন ডলারের মামলা দায়ের করেন। রাহিলের মৃত্যুর পিছনে ড্রিল সার্জেন্টদের কঠোর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ফ্যাক্টর হিসাবে উল্লেখ করা হয়।
সম্ভবতঃ রাহিল সিদ্দিকী একই ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন; যেমনটি করা হয়েছিল ল্যান্স করপোরাল আমীর বুরমেই এবং রেকন হুযেজের সঙ্গে।
কোর্ট-মার্শাল বিচারের সময় বুরমেই এর বর্ণনায় জানা যায় যে, ফেলিক্স তাকে একটি শিল্প-গ্রেড কাপড়ের ড্রায়ারের মধ্যে বসতে বাধ্য করেন এবং ইসলাম ত্যাগ করার জন্য চাপ দেন। বুরমেই এই কাজ করতে অস্বীকৃতি জানালে মেশিনটি চালিয়ে দেয়া হয় এবং আরো ক্ষতির আশংকা থেকে বুরমেই তার ধর্মকে ত্যাগ করতে রাজী হলে পরে তাকে মুক্তি দেয়া হয়।
ইরাকের কুর্দি বংশোদ্ভূত রেকন হুযেজও ফেলিক্সের কাছ থেকে অনুরূপ হুমকির মুখোমুখি হন। তিনি জানিয়েছিলেন যে ফেলিক্স ও অন্য আরেকজন ড্রিল সার্জেন্ট বুরুমেই’র মতো একইভাবে তাকেও ড্রায়ারে বসতে বাধ্য করা হয়েছিল।
ফেলিক্সকে দশ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো ছিল পারিস দ্বীপে অ্যালকোহলের বশবর্তী হয়ে প্রায়ই শারীরিক এবং মৌখিক অপব্যবহার করা।
আরেকটি সমানভাবে হৃদয় বিদারক ঘটনা হচ্ছে ১৭ বছর বয়সী ভার্জিনিয়ার রেস্টনের বাসিন্দা নাবরা হাসানেনের মৃত্যু। উষ্ণ, প্রাণবন্ত, বুদ্ধিমতী এই কিশোরী মাত্রই উচ্চ মাধ্যমিক ক্লাসের তার দ্বিতীয় বছরটি সম্পন্ন করেছিলেন।
মিশরীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম পরিবারের চারজন কন্যার একজন ছিলেন নাবরা এবং রমজানের সময় ফজরের নামাজ আদায়ের জন্য নিয়মিতভাবে মসজিদে উপস্থিত হতেন।
২০১৭ সালের ১৮ জুলাই রাতে আইএইচপিতে সেহরি খাওয়ার পর নাবরা ও তার বন্ধুরা ‘অল ডিউলস এরিয়া মুসলিম সোসাইটি’র মসজিদে নামাজ পড়ে ফিরছিলেন। এসময় ডারউইন মার্টিনেজ-টরেস নামে ২২ বছর বয়সী এক ব্যক্তি তাদের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হয়।
তর্কের এক পর্যায়ে লোকটি তার গাড়ি নিয়ে নাবরা ও তার বন্ধুদের পিছন থেকে দাওয়া করতে শুরু করেন এবং অবশেষে নাবরাকে ধরে ফেলেন। আবায়া পরিধানরত নাবরার ওপর গাড়ি চালিয়ে দেয়ার আগে তাকে বেসবলের ব্যাট দিয়ে আঘাত করা করা হয়।
এরপর তার ওপর শারীরিক ও যৌন নির্যাতন চালানো হয় এবং একসময় মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়েন। পরবর্তীতে টোরেস তার মৃতদেহটি তার অ্যাপার্টমেন্ট কাছাকাছি একটি পুকুরে ফেলে দেন। গ্রেপ্তার হওয়ার পর তিনি নাবরার লাশের অবস্থান পুলিশকে জানান।
পুলিশ শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যুকে রাস্তায় ক্ষুব্ধ সংঘাতের একটি দুঃখজনক ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দেয়। স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেক সদস্য পুলিশের এই ব্যাখ্যায় অন্ধকারে থেকে যান। তারা তার মৃত্যুকে ঘৃণা অপরাধ হিসেবে বর্ণনা করেন।
‘নাবরার জন্য ন্যায় বিচার’ শীর্ষক প্রচারাভিযানে টরেসের অপরাধের জন্য তাকে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়।
যাইহোক, তার বাবা দুঃখের সঙ্গে উল্লেখ করেছিলেন যে, তার মেয়ের মৃত্যুর প্রকৃতি যাইহোক না কেন এটি কখনই তার জীবনকে আর ফিরিয়ে আনতে পারবে না। অনেকেই নাবরা ও সিদ্দিকীর মৃত্যুর বিষয়টিকে ক্রমবর্ধমান ইসলামফোবিক প্যাটার্নের অংশ হিসাবে দেখেন; যেখানে তরুণ মুসলিমদের টারগেট করে হামলার ঘটনা ঘটানো হচ্ছে।
২০১৭ সালের ২৮ নভেম্বর তারিখে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাজ্যের ডানপন্থী দল ‘ব্রিটেন ফার্স্ট’ নেত্রী জায়ডা ফ্রানসেনের পোস্ট করা তার ধারাবাহিক ইসলামফোবিক ভিডিও’র মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে পুনরায় টুইট করেন।
ভিডিওগুলোতে দেখানো হয় যে মুসলমানরা ইউরোপে সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িত। যদিও পরে একটি ভিডিওতে দেখা গেছে ‘মুসলমান অভিবাসী’র পরিবর্তে একজন ডাচ নাগরিক অন্য একজন ব্যক্তির ওপর হামলা চালাচ্ছেন।
ইসলামফোবিয়া নিয়ে ‘ব্রিটেন ফার্স্ট’ এর ডেপুটি নেতা ফ্রানসেনের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে এবং আক্রমণ ও ঘৃণা-সংক্রান্ত অভিযোগে তিনি অনেকবার গ্রেপ্তার করা হয়েছেন।
লেখক পরিচিতি: আকবার আহমেদ একজন খ্যাতিমান লেখক, কবি, চলচ্চিত্র নির্মাতা, নাট্যকার এবং ওয়াশিংটন ডিসিতে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের ইবনে খালদুনের চেয়ারম্যান। তিনি পূর্বে ইউকে এবং আয়ারল্যান্ডে পাকিস্তানি হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ডেইলি টাইমস