IQNA

‘অস্ট্রেলিয়ায় ইসলামভীতি দূর করতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে’

21:20 - October 15, 2017
সংবাদ: 2604072
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ভীত সন্ত্রস্ত, নিপীড়িত, রাষ্ট্রহীন, গৃহহীন এবং এখনো পর্যন্ত কার্যকর আন্তর্জাতিক সমর্থন থেকে বঞ্চনা – এই হলো রোহিঙ্গাদের দুর্দশার অবস্থা; যারা মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও চরমপন্থী বৌদ্ধদের নৃশংস হামলার মুখে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে।

বার্তা সংস্থা ইকনা: মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হাতে দুই শতাধিকরেও বেশি রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়ে গেছে। এর ফলে প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে।

ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু মিডিয়া কভারেজের কারণে রোহিঙ্গাদের নিপীড়নের কাহিনী খুব সামান্যই জানতে পেরেছে পশ্চিমারা।

নতুন কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে বসতি স্থাপন করায় অনেক বাস্তুচ্যুত মুসলমানদের মতো অরক্ষিত এসব রোহিঙ্গাদেরও ভয় ও অসন্তুষ্টিকে মোকাবেলা করতে হতে পারে।

হঠাৎ করে যদি কিছু রোহিঙ্গা আমাদের ভাগ্যবান দেশটিতে আশ্রয় নেয়, তাহলে সেখানে তারা এক অপ্রীতিকর অবিরাম ইসলামোফোবিয়া বা ইসলামভীতির অভিজ্ঞতা অর্জনের দৃঢ় সম্ভাবনা রয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ায় ইসলামোফোবিয়া কতটা গুরুতর সমস্যা?

একজন অস্ট্রেলিয়ান, আধুনিক, শিক্ষিত, মুসলিম নারী হিসাবে আমি সচেতনভাবে উপলব্ধি করছি যে বিষয়টি একটি বিশেষাধিকারের অবস্থান থেকে এসেছে।

১৯৭০ এর দশকে যখন হোয়াইট অস্ট্রেলিয়ান নীতি এবং ‘আত্তীকরণ গুঞ্জনধ্বণি’ ছিল, সেই সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় একজন অভিবাসীর সন্তান হিসেবে আমার মতো অনেক ইতালীয়, গ্রীক, এশিয়ান এবং অ্যাভরিজিনাল বন্ধুদের মতই আমিও নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করতাম। বিশেষকরে মৌখিক আক্রমণ ও মাঝে মাঝে শারীরিক আক্রমণগুলো এড়ানোর চেষ্টা করতাম। এসব আক্রমণের বেশির ভাগই আসত স্কুলের শ্বেতাঙ্গ শিশুদের কাছ থেকে।

সেই দিনগুলোতে ইসলাম বা মুসলমানদের সম্পর্কে মানুষজন খুব কমই জানত এবং আমাদের সম্প্রদায় ছিল তুলনামুলকভাবে ছোট। তাই যতক্ষণ না আমরা নিজেদেরকে ‘সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতার’ যোগ্য বলে প্রমাণিত করতে করতাম ততক্ষণ আমাদেরকে ‘জনি ফরেনার’ শ্রেণিতে রাখা হতো। কিন্তু তখন আমরা দেশের রাজনীতিবিদ কিংবা জাতীয়তাবাদীদের বিশেষ লক্ষ্যবস্তু ছিলাম না; যেমনটি বর্তমান সময়ে মুসলিমরা শিকার হচ্ছেন।

বেশ কয়েকটি স্বাধীন প্রতিবেদন হতে দেখা যায় যে, ২০০১ সাল থেকে বৃদ্ধি পাওয়া ইসলামভীতির অধিকাংশ শিকার হয়েছে মুসলিম নারীরা ও তাদের সন্তানরা।

২০০৪ সালে ওয়েস্ট সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অফ কালচারাল রিসার্চ কর্তৃক মানবাধিকার ও সমান সুযোগ কমিশনের একটি প্রতিবেদনে ১১ সেপ্টেম্বর পরবর্তী অস্ট্রেলিয়ান-আরব এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে জাতিবিদ্বেষের ঘটনাসমূহ ওঠে আসে। এতে আরব ও মুসলিম অস্ট্রেলিয়ানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও রুঢ়ভাবে জাতিবিদ্বেষ বৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায়।

সেখানে ৯৩ শতাংশ উত্তরদাতাই জানিয়েছিলেন যে, তাদের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বর্ণবাদ, অপব্যবহার এবং সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ফলাফল ছিল যে পুরুষদের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে নারীরাই বেশি অপব্যবহারের শিকার।

২০১৫ সালে সাউথ অস্ট্রেলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর রিয়াজ হাসান ও বিল মার্টিনের ‘ইসলামোফোবিয়া, সামাজিক দূরত্ব এবং অস্ট্রেলিয়ায় সন্ত্রাসবাদের ভয়’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা গেছে অস্ট্রেলিয়ার ১০ শতাংশ নিজেদেরকে অত্যন্ত ইসলামোফোবিক বলে বর্ণনা করেছেন। ২০ শতাংশ দ্বিধান্বিত ছিল এবং ৭০ শতাংশ নিজেদেরকে কম ইসলামোফোবিক হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন।

প্রফেসর হাসানের মতে, যারা নিজেদেরকে কম ইসলামফোবিক বলে মনে করে; তাদের শিক্ষা ও সচেতনতাই ছিল শান্তিপূর্ণ মুসলমানদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পরিবর্তনের চাবিকাঠি।

২০০৪ সালে মারিয়াম ভেসজাদে’র ‘ইসলামোফোবিয়া রেজিস্ট্রার অস্ট্রেলিয়া’ শিরোনামের প্রতিবেদনে ইসলাফোবিক ঘটনাসমূহ বিশ্লেষণ করা হয়। মারিয়াম লক্ষ্য করেন যে যখন ব্যাপক গবেষণা এবং তথ্য-উপাত্তসমূহ মৌলবাদকে বুঝাত (বিশেষত ইসলামিক মৌলবাদ) তখন এটি নিরাপত্তা ও একটি সামাজিক সমস্যা হিসাবে গণ্য হতো। কিন্তু যখন ইসলামোফোবিয়া গবেষণাধীন ছিল, তখন এটি ব্যাপকভাবে সামাজিক সম্প্রীতিকে প্রভাবিত করার গুরুতর বিষয় হিসাবে দেখা হতো না।

‘অস্ট্রেলিয়ায় ইসলামফোবিয়া’ শীর্ষক চার্লস স্টোয়ার্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার যৌথ রিপোর্টে দেখা গেছে, মুসলিম নারীরা, বিশেষ করে হিজাব পরা নারী ও তাদের সন্তানরা বেশিরভাগ ইসলামভীতির আক্রমণের শিকার হন।

ভিকটিমদের ৭৯.৬ শতাংশ নারী এবং ৪৭ শতাংশ তাদের সন্তানরা সরাসরি কিংবা পরোক্ষ আক্রমণের শিকার। এসব অপরাধীর অধিকাংশই পুরুষ। ইসলামোফোবিয়া মুসলমানদের বৈপরীত্য আচরণকে স্বীকৃতি দেয় না এবং এইসব আক্রমণ মুসলিম নারী ও তাদের সন্তানদের আত্মবিশ্বাসহীন করে তুলে।

আমার এক বান্ধবীর মেয়ে এখন বাড়িতে হাঁটাহাঁটির সময়ও গভীরভাবে ভীত সন্ত্রস্ত থাকে। শ্বেতাঙ্গ এক তরুণ হঠাৎ তার গাড়ি থেকে নেমে ওই কিশোরী গালাগালি শুরু করে এবং খেলনা বন্দুক দিয়ে তাকে গুলি করার ভান করে। মেয়েটি বাড়ি ফিরে ফ্যাকাশে হয়ে যায় এবং কাঁপতে থাকে। সে আর কখনো একা একা বাড়ি থেকে বের না হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ রকম ঘটনা এখন অস্ট্রেলিয়াতে অহরহ ঘটছে।

‘ইসলামোফোবিয়া ইন অস্ট্রেলিয়ার’ রিপোর্টে দেখা যায়, কর্তৃপক্ষের অপর্যাপ্ত প্রতিক্রিয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা তাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের বিষয়ে রিপোর্ট করতে অনিচ্ছুক।

মুসলিম, বিশেষ করে মুসলিম নারীরা ইসলামফোবিক আক্রমণকে অস্ট্রেলিয়ান সমাজের একটি অংশ হিসেবে গণ্য করে তা সহ্য করার মানসিকতা তৈরি করছে। অমুসলিমরা প্রায়ই ইসলামফোবিয়াকে একটি অনিবার্য হিসাবে গ্রহণ করে। যা সত্যিই দুঃখজনক সামাজিক প্রপঞ্চ।
লেখক: রাবিয়া সিদ্দিক একজন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মী, পেশাদার বক্তা এবং লেখক। আরটিএনএন
captcha